তখন শিয়ালদা স্টেশন মানেই উদ্বাস্তুদের ভিড়। স্বাধীনতার পর কেটে গিয়েছে ছয় বছর। কিন্তু উদ্বাস্তু স্রোত থামেনি। বিভিন্ন রাজ্যে উদ্বাস্তুদের পাঠানোর পরিকল্পনা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ওই শোনা যাচ্ছে পর্যন্তই। বাংলা ও বাঙালির উপর চাপ বাড়ছে অন্য এক বঙ্গভূমি ছেড়ে আসা মানুষগুলোর (বা হয়তো মানুষের মতো দেখতে প্রাণীদের)। চতুর্দিকে খাবারের সংকট, চাকরির সংকট। অবস্থা যখন এমন, ভরা দুপুরে একদিন কলকাতা হঠাৎ উত্তাল। কাতারে কাতারে মানুষ নেমে এল রাস্তায়। বছরের মাঝামাঝি সময়, জুলাইয়ের গোড়ায় পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বেঁধে গেল জনসাধারণের। লাঠিচার্জ, গ্রেফতারি, ধাক্কাধাক্কি, পুলিশের দিকে পাথর ছোঁড়ার মাঝে উন্মত্ত জনতা আগুন ধরিয়ে দিল ট্রামে। স্বাধীন ভারতের কলকাতা হঠাৎ কী নিয়ে জ্বলে উঠল? কেন জ্বলে উঠল সাধারণ মানুষ? খবর এল, ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে!
কত ভাড়া বাড়ানোয়?
১৯৫৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। তখনও ব্রিটিশ সংস্থা ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি কলকাতার ট্রাম চালায়। ওই বছর ১ জুলাই থেকে তারা ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু বর্ধিত ভাড়া দিতে অস্বীকার করে সাধারণ মানুষ। নেপথ্যে সমর্থন ছিল কংগ্রেস বাদে বাকিসব রাজনৈতিক দলগুলির। ভাড়া বাড়লেও পুরনো ভাড়াতেই যাতায়াত করতে থাকে সাধারণ মানুষ। ভাড়া নিতে না চাইলে বিনা ভাড়াতেই! ৩ জুলাই ভাড়া আদায়ের চেষ্টায় পুলিশকে নামতে হয় রাজপথে। বেঁধে যায় খণ্ডযুদ্ধ। সারাদিন চলল মারধোর, লাঠিচার্জ, গ্রেফতারি, পুলিশকে মারা, আগুন ধরিয়ে দেওয়া। কত ভাড়া বাড়ানোয় এমন বিশাল আকারের প্রতিবাদ? ১ পয়সা।আরও পড়ুন - ‘জাতীয় সংগীত নিয়ে ওর ভাবনাটা আজও…’ সহজ পরবে কালিকাপ্রসাদকে নিয়ে নস্টালজিক লোপা
একমাত্র ভরসার স্থল
শুনতে নেহাতই নগণ্য। তবু এই ১ পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির নাগরিক প্রতিক্রিয়াই বলে দেয় তৎকালীন বাংলার পরিস্থিতি। দুর্ভিক্ষ, উদ্বাস্তু সমস্যা, বেকারত্বের মাঝে মানুষের একমাত্র ভরসার স্থল ছিল স্বল্প ভাড়ার গণপরিবহন — ট্রাম। তাই ১ পয়সা হলেও ভাড়াবৃদ্ধির তীব্র প্রতিক্রিয়া আছড়ে পড়েছিল কলকাতার বুকে।
১৮৭৩ সালের এই তারিখেই
আজ ২৩ ফেব্রুয়ারি। ১৮৭৩ সালের এই তারিখেই কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা শুরু করে ইংরেজরা। শিয়ালদা থেকে আর্মেনিয়ান ঘাটের মধ্যে প্রথম আড়াই কিমি ট্রাম চলাচল আরম্ভ হয়। এর ৭ বছর পর ১৮৮০ সালে লন্ডনে ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি তৈরি হয়। তারাই দায়িত্ব নেয় কলকাতায় ট্রাম চালানোর। প্রথম দিকে ট্রাম ঘোড়ায় টানা গাড়ির মতো চলত। কিন্তু ১৮৮২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে স্টিম ইঞ্জিনে ট্রাম চালানো শুরু হয়। ১৯০০ সালে ট্রাম লাইনের সমান্তরালে বিদ্যুতের তার দেখল কলকাতা। সস্তার গণপরিবহন হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ট্রাম। প্রথম ক্লাস অবশ্য নয়। দ্বিতীয় ক্লাসটাই ছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও কর্মজীবী মানুষের। সেই শ্রেণির ভাড়া ১ পয়সা বাড়ানোর জেরেই বৃহত্তর প্রতিবাদে নামে সাধারণ মানুষ। পুলিশের লাঠির মুখে হয়ে ওঠে মারমুখী। আগুন ধরিয়ে দেয় দুপুরের ভাতের মতো রোজকার যাত্রাসঙ্গী সাধের ট্রামে।আরও পড়ুন - ‘মেয়ে-বউদের নিয়ে হুমকি দিত’ ট্যাংরাকাণ্ডে এবার বিস্ফোরক প্রণয়-প্রসূন