Mahavir Jayanti:🦄 ‘হিংসে করিস না দাদু। যত হিংসে করবি, তত পাওয়ার ইচ্ছে বাড়ে। আর ততই বাড়ে হারানোর ভয়! মহাবীর তো সে কথাই বলেছিলেন। অহিংসা মানুষের বড় ধর্ম।’
💫নাতিকে নিয়ে পুরুলিয়া ঘুরতে এসেছেন সুকোমল প্রামাণিক। ক্লাস ফাইভের ছাত্র অতীন ঘুরতে এসেও প্রীতমকে ক্লাস নোটস না দেওয়া নিয়ে নানা অজুহাত দিয়ে চলেছে। রঘুনাথপুর থেকে একটা রাস্তা সোজা চলে যায় নবগ্রাম, কুমারডিহির দিকে। মাঝপথে এক জায়গায় পড়ে বান্দার দেউল। প্রাচীন জৈন মন্দির। গাইডের কথামতো সেই মন্দির ঘুরতে ঘুরতেই নাতিকে কথাটা বললেন সুকোমলবাবু। অন্যান্য সাবজেক্টের চাপে স্পিরিচুয়ালিটির পড়া বেশি মনে থাকে না অতীনের। মহাবীর নামটা সে শুনেছে। কিন্তু তাঁর ব্যাপারে সবটা মনে নেই। তাঁর বলা কথা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? এ প্রশ্ন করতেই নাতির হাত ধরলেন সুকোমলবাবু। পাড়ি দিলেন আড়াই হাজার বছর আগের ভারতবর্ষে।
বৃদ্ধির চিহ্ন যার জন্মে
🌞৫৯৯ খ্রিষ্টপূর্বের বৈশালী, বর্তমানে বিহারে অবস্থিত এই অঞ্চল তখন এক সমৃদ্ধ জনপদ। রাজা সিদ্ধার্থ ও রানি ত্রিশলার গর্ভে জন্ম নিল এক অলৌকিক শিশুপুত্র। নাম রাখা হল বর্ধমান। নামের নেপথ্য কারণ তখন সিদ্ধার্থের রাজ্য সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বর্ধিত হচ্ছে রাজ্যসুখ। রাজপুত্রের নামকরণ হল সেই সূচকেই।
আরও পড়ুন - 💟Ram Navami 2025: শাক্ত-বৈষ্ণবদের অসামান্য মিলনভূমি বঙ্গদেশ, শ্রীরাম বাঙালির মনের কতটা কাছের? কী বলছে ইতিহাস
পরবর্তী বৃক্ষ
🦩‘শ্বেতাম্বর আচারঙ্গ’ সূত্র অনুযায়ী, ছোট থেকেই পুত্রের নানা অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী সিদ্ধার্থ ও ত্রিশলা। সন্তান ছোট থেকেই বুদ্ধিমান, শান্ত। উজ্জ্বল, গভীর দৃষ্টি তাঁর। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন জৈন ধর্মের অনুসারী। জৈন ধর্মের তেইশতম তীর্থঙ্কর পরেশনাথ তাঁদের ঈশ্বর। সেই সূত্রে বর্ধমানের শৈশব জুড়েও পড়েছিল জৈন ধর্মের মহান আদর্শের ছায়া। কিন্তু কে জানত এই ছায়াতে পুষ্ট হতে হতে একদিন তিনিই পরবর্তী বৃক্ষ হয়ে উঠবেন। হয়ে উঠবেন ছায়াদাতা।

তারুণ্যের চরম মুহূর্তে ত্যাগের পথ
🧜৫৬৯ খ্রিষ্টপূর্ব, ৩০ বছর বয়স। তারুণ্যের চরম মুহূর্তে ত্যাগের পথ বেছে নিলেন সিদ্ধার্থপুত্র। সংসার ও রাজ্য ছেড়ে মোক্ষের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন বর্ধমান। ত্যাগ করলেন বিলাসিতা, সম্পর্ক, মোহ; ত্যাগ করলেন যাবতীয় সব কিছু যার উপর মানুষ নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠায় সদাব্যস্ত। ত্যাগ করলেন বস্ত্রও! জীবপ্রেম ও অহিংসার পথে শুরু হল গভীর ধ্যান। সঙ্গ হল চরম কৃচ্ছসাধন ও মৌনতা। দীর্ঘ ১২ বছর ধ্যানের পর পরম জ্ঞান লাভ করেন বর্ধমান। পূর্বজন্ম পার করে পৌঁছান জীবনের অপর তীরে, যে তীরে তাঁর নাম মহাবীর।
বারংবার আক্রমণেও অবিচল
🥃মোক্ষ লাভের পর সারা ভারত ভ্রমণ শুরু হল মহাবীরের। জীবনের গুরুতর বাধাবিপত্তি ও যন্ত্রণার সুরাহা পাওয়ার আশায় তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হলেন ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সব ধরনের নারীপুরুষ। মহাবীরের এই ভারত ভ্রমণেরই অংশ ছিল বঙ্গদেশ। বিহারের বৈশালীর অদূরেই বাংলার বর্ধমান ও বীরভূম। আচারঙ্গ সূত্র মতে, এই দুই অঞ্চলেই দীক্ষা শেষে এসেছিলেন মহাবীর। বহু চাতুর্মাস (চার মাসের এক পবিত্র সময়) তাঁর এই অঞ্চলে কেটেছে। তবে এখানেই বারংবার তাঁকে আদিবাসী-উপজাতিদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। সহ্য করতে হয়েছে জন্তুদের আক্রমণও। ভগবতী সূত্র গ্রন্থ অনুযায়ী, এই অঞ্চলে শূলপাণি যক্ষ তাঁর উপর অজস্রবার আক্রমণ করেন। কখনও বন্যহাতি, কখনও বা বিষধর নাগের রূপ ধরে আহত করেন মহাবীরকে। বর্তমানে বর্ধমানের অস্তিগ্রামে এই যক্ষের একটি মন্দিরও রয়েছে।
আরও পড়ুন - 🐼Ghibli Art: শিল্পীর কল্পনাও কি এবার এআই করে দেবে? জিবলি বিতর্কে ভাবাচ্ছে সেই প্রশ্ন
বর্ধমান ও বীরভূমে মহাবীর
ꦦবাংলার আদি ধর্মচর্চার সঙ্গে একদিকে যেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন বুদ্ধ, তেমনই অন্যদিকে রয়েছেন মহাবীর। মহাবীরের বঙ্গযোগ প্রত্যক্ষ। কারণ রাঢ় বঙ্গে জৈনধর্মের প্রচারক ছিলেন চব্বিশতম তীর্থঙ্কর মহাবীর স্বয়ং। দীক্ষালাভের পর তিনি বাংলার বিস্তৃত রাঢ় অঞ্চলে দীর্ঘ কাল যাপন করেছেন। মনে করা হয়, বর্ধমান জেলার নামকরণ তাঁরই শৈশব-নাম বর্ধমান অনুসারে হয়েছিল। এছাড়াও জৈন শাস্ত্র মতে, সাঁইথিয়া শহরের কাছাকাছি এক স্থানে বিষধর নাগকে সম্পূর্ণ বশীভূত করেন মহাবীর। মহাবীরের নাম থেকেই পরবর্তীকালে সাঁইথিয়া ও সংলগ্ন এলাকা নিয়ে গঠিত জেলার নামকরণ বীরভূম হয়েছে বলে কথিত রয়েছে। তবে বর্ধমান ও বীরভূম বাদে আরেকটি জেলায় দেখা যায় জৈনধর্মের প্রাবল্য। সেটি পুরুলিয়া।

রাঢ় বঙ্গে শেষ তীর্থঙ্কর
💞আজও ব্যাপক মাত্রায় আদিবাসী অধ্যুষিত ও লোক সংস্কৃতিময় পুরুলিয়া জেলা। কিন্তু এই জেলারই এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু জৈন মন্দির। কিছু কিছু মন্দির জৈন না হিন্দু, এই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে থাকেন পুরাতত্ত্ববিদেরা। তার পরেও জৈনমন্দিরের সংখ্যা এই অঞ্চলে কম নয়। বনবীর দেউল, বান্দার দেউল তেমনই প্রাচীন নিদর্শন। বঙ্গদেশে জৈন ধর্ম এমনই ব্যাপকতা ও স্থায়িত্ব লাভ করে যে, মহাবীর প্রয়াণের হাজার বছর পরেও রাঢ় অঞ্চলে তাঁর প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল। সেই প্রভাবেরই ফসল এই মন্দিরগুলি। পুরাতত্ত্ব অনুসারে, রাঢ় অঞ্চলের মন্দিরগুলির অধিকাংশের নির্মাণ কাল ন'শো খ্রিষ্টাব্দ থেকে বারোশো খ্রিষ্টাব্দ।
পদাঙ্ক বুকে নিয়ে
ꦯবান্দার প্রাচীন দেউলেই মহাবীরের কাহিনি শুনছিল মুগ্ধ অতীন। কাহিনি শেষে তাঁর প্রশ্ন, মন্দিরের তাহলে এমন হাল কেন? সুকোমলবাবু এর কোনও উত্তর খুঁজে পেলেন না। বান্দার দেউল শুধু নয়, প্রাচীনত্ব ও জরা স্পর্শ করেছে এমন বহু জৈন দেউলকেই। গোটা রাঢ় অঞ্চল জুড়ে যেসব জৈন মন্দির প্রাচীনকালে নির্মিত হয়েছিল, তাদের অবস্থা বেশ সঙ্গীন। কিছু কিছু ভগ্নপ্রায়। কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষ্য দিতে ভোলেনি কেউই। ভাঙা পায়েই কোনও মতে দাঁড়িয়ে থাকা দেউল ভারতবর্ষের এক যুগপুরুষের সঙ্গে আজও অক্ষুণ্ণ রেখেছে এই বঙ্গের প্রাচীন যোগ।