ফুটবল হল বাঙালির আবেগ, ভালবাসা, প্যাশন। এই ফুটবলপ্রেম থেকেই একদিন জন্ম নিয়েছিল ময়দানের অনন্য এক সংস্কার, যার নাম ‘বারপুজো’। পয়লা বৈশাখে ক্লাবের ‘বার’-এর পুজো করাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল এই ঐতিহ্য। বাঙালির বিশ্বাস, বছরের প্রথম দিনে যদি শুভ সূচনা হয়, তবে গোটা বছরটিও শুভ কাট❀বে। আর তাই নববর্ষের দিনেই ময়দানের প্রায় সমস্ত ক্লাব বারপুজো আয়োজন করে থাকে। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের মতো বড় ক্লাবগুলিতে এই পুজোর জৌলুস এক সময় দুর্গাপুজোর সমতুল্য ছিল।
এক সময় পয়লা বৈশাখ দিয়েই শুরু হত কলকাতার ফুটবল মরশুম। আসলে তার আগেই শেষ হয়ে যেত দলবদলের⛦ পর্ব। নতুন মরশুমের সূচনায়, নবনিযুক্ত অধিনায়কের নাম ঘোষণার পাশাপাশি ‘বার’কে ঘিরে পুজো হত ক্লাব চত্বরেই। দলের নতুন ফুটবলারদের সঙ্গে সমর্থকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হত। এই সময়ে কালীঘাট থেকে আসা পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করে পুজোর আয়োজন♕ করতেন। পুজোর সময় বার ঘিরে থাকত অতন্দ্র প্রহরীরা, কারণ প্রচলিত বিশ্বাস, কেউ যদি পুজোর আগে ‘বার’ ডিঙিয়ে যায়, তবে তা ক্লাবের পক্ষে অশুভ। তাই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মাঠে নামার আগেই ক্লাবের ‘বার’-কে রক্ষা করা হত। আসলে ‘বার’-কে গোটা ময়দান ফুটবল দেবতার সঙ্গে তুলনা করে থাকে। যদি ফুটবলের দেবতা খুশি হন , তাহলে গোটা বছরটা ভালো কাটবে, এটাই ছিল সকলের ধারনা।
আরও পড়ুন …. মোহনবাগানে কি সৃঞ্জয় বসুর প্রত্যাবর্তন হতে চলেছে? বারপুজ꧟োর দিনে সবুজ মেরুন নির্বাচনের জল্পনায় আগুন
তবে এই বারপুজোকে কেন্দ্র করে আরও একটি গল্প রয়েছে। আসলে বর্তমানে বাংলার নতুন বছরের শুরু দিকে ফুটব൲লের একটা মরশুম শেষের পথে থাকলেও শেষ হয় না,✤ তবে অতীতে বাংলার নতুন বছরের পরেই শুরু হতো নতুন মরশুম। আর নতুন মরশুমের আগে প্রত্যেকটা দল নিজেদের গুছিয়ে নিত। সেই সময়ে মোহবাগান, ইস্টবেঙ্গল ও মহমেডানের মধ্যে ফুটবলার নিয়ে প্রচন্ড লড়াই দেখা যেত। ফুটবলার অপহরণেরও খবর পাওয়া যেত। সেই কারণেই সবচেয়ে দামী ফুটবলারদের নিজেদের ডেরায় আটকে রেখে ১লা বৈশাখে, বারপুজোর দিনে সমর্থকদের সামনে আনা হত। সেই কারণেই বাংলা ফুটবলে বারপুজোর গুরুত্ব অন্য ছিল। যা দেখার জন্য প্রচুর সমর্থক মাঠে আসতেন।
তবে পুজো শেষে সদস্য ও সমর্থকদের জন্য থাকত খাওয়াদাওয়া, বিশেষ করে মোহনবাগানে লুচি, বোঁদে ও পান্তুয়ার ট্র্যাডিশন ছিল কিংবদন্তিসম। প্রিয় ফুটবলারদের দেখা সঙ্গে প্রিয় ক্লাবের জন্য প্রার্থনা ও এর পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ও পরে একটা প্রীতিভোজ, দিনটাকে অন্য রকম꧂ করে দেয়। তবে বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা অনুষ্ঠান, যেটা এই দিনটাকে আরও বিশেষ করে তুলেছে।
আরও পড়ুন …. '১৮'-র যোগে এবার IPL জিতবে RCB? প꧙্রশ্ন শুনে বেঙ্গালুরু ফ্যানদেরই ট্রোল বিরাটের
তবুও, বারপ♕ুজোর মাহাত্ম্য এখনও অটুট। শুধু ক্লাবের মঙ্গল কামনাই নয়, এই দিনে প্রার্থনা করা হয় সমাজের মঙ্গলের 🔥জন্যও। ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে ভিনধর্মের খেলোয়াড়েরাও অংশ নেন পুজোয়। ফুটবল এখানে হয়ে ওঠে সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্র। বারপুজোর ইতিহাস হয়তো এখনও অস্পষ্ট, তবে তার তাৎপর্য অনস্বীকার্য।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন এই পুজোয় কী মন্ত্র পাঠ করা হয়? তা নিয়েও মতবিরඣোধ আছে। কেউ বলেন লক্ষ্মীমন্ত্র, কেউ বলেন বিশ্বকর্মার মন্ত্র। আসলে হিন্দু ধর্মীয় আচার নয়, মুখ্য হয়ে ওঠে ক্লাবের সকলকে এক সূত্রে বাঁধার আয়োজন। সমর্থক, খেলোয়াড়, কর্মকর্তা সবাই মিলে যেন এক পরিবারের মতো মিলিত হন এই দিনে। এই বারপুজো অন🥂্য কোনও রাজ্যে, অন্য কোনও দেশে দেখা যায় না। এটা শুধু বাংলা ফুটবলের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে।
আরও পড়ুন …. ভিডিয়ো: পন্তের কাঁধে হাত রে✨খে ধোনি ও গোয়েঙ্কার আড্ডা!☂ বাইশ গজে ফিরল পুরনো দিনের গল্প
বর্তমানে বারপুজো অনেকটাই কর্পোরেট রঙে রঙিন হয়েছে, অনে💞কটাই ‘বাংলিশ’। কাদা-মাটির মাঠ আর নেই, বাঙালির নিজস্ব ঘরোয়া দল গঠনের প্রবণতাও কমে গিয়েছে। ক্লাবের দলে এখন বেশি সংখ্যক বিদেশি বা ভিনরাজ্যের খেলোয়াড়। ফলে ঐতিহ্যের আবেগ অনেক সময়ই তাদের কাছে অপরিচিত। তবুও, পয়লা বৈশাখের সকালে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের তাঁবু আজও থাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সজ্জিত। সমর্থকদের আনাগোনা থাকে নিয়মমাফিক। মাঠ ও তাঁবুকে সাজিয়ে ফেলা হয়। তবে শুধু মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল কেন, এই ছবি বাংলার প্রায় প্রত্যেক ফুটবল মাঠেই দেখা যায়। যেখানে ‘বার’ থাকে, ফুটবল থাকে। এই পুজো ময়দান টোপকে বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করেন, অধিনায়ক-কর্তা-সমর্থক সকলেই নতুন মরশুমে সাফল্যের সংকল্প নেন। যেন ঠিক পুজোর দিনগুলির মতোই থাকে আচার-অনুষ্ঠান। সেই সুবাস, সেই উত্তেজনা এখনও অনেকের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।
সত্যিই, ফুটবল বাংলার জীবনচর্যায় এমনভাবেই মিশে আছে যে, তা শুধু মাঠে আটকে🅷 থাকে না। সাহিত্য, গান, নাটক, এমনকি সেলুলয়েডেও তার স্পষ্ট ছায়া পড়ে। আর পয়লা বৈশাখ মানেই বারপুজোর আঙ্গিকে ফুটবল-প্রেমিক বাঙালির কাছে এক অন্যরকম আবেগ। সময় বদলেছে, আবরণ পাল্টেছে, কিন্তু ফুটবলপ্রীতি আর বারপুজোর গন্ধ এখনও বাঙালির রন্ধ্রে-রন্ধ্রে রয়ে গিয়েছে আগের মতোই।